জয় ভিশন অনলাইন:
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অর্থ পাচারকারীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দেশের আলোচিত-সমালোচিত ১৭ ব্যক্তি এবং তাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কী পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়েছে, এ বিষয়ে অনুসন্ধানে নেমেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
এর মধ্যে রয়েছে বেক্সিমকো গ্রুপের মালিক সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
বাকিরা বহুল আলোচিত এস আলম গ্রুপের মালিক মো. সাইফুল আলম, ওরিয়ন গ্রুপের (পাওয়ার প্ল্যান্ট) চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিম, সামিট গ্রুপের (পাওয়ার প্ল্যান্ট) চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান, নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী এবং গাজী গ্রুপের মালিক গোলাম দস্তগীর গাজী, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক উপকমিটির সদস্য দিলীপ কুমার আগরওয়ালা, ঢাকা সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও এনা পরিবহণের মালিক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, চৌধুরী নাফিজ সরাফাত, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধ) সাবেক সভাপতি লিয়াকত আলী শিকদার, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত স্টাফ জাহাঙ্গীর আলম ওরফে পানি জাহাঙ্গীর, সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর ছত্রছায়ায় প্রতারণা ও বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ থাকা ফেরদৌসী আলম নীলা ওরফে নীলামার্কেটের নীলা, সাবেক সংসদ-সদস্য রমেশ চন্দ্র সেনের ছত্রছায়ায় কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ থাকা মুক্তা রাণী, সাদিক অ্যাগ্রোর মালিক মো. ইমরান হোসেনসহ অপর একটি শিল্পগ্রুপের মালিক।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত স্টাফ জাহাঙ্গীর আলম ছিলেন সুধা সদনে খাবার পানি সরবরাহকারী। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী বলে পরিচয় দেওয়া শুরু করেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রভাব খাটিয়ে ৪০০ কোটি টাকার মালিকসহ গাড়ি-বাড়ির মালিক হওয়ার অভিযোগের অনুসন্ধান করছে সংস্থাটি। জাহাঙ্গীরের স্ত্রী কামরুন নাহারের নামে ৭ কোটি ৩০ লাখ টাকার সম্পদ থাকার অভিযোগ রয়েছে।
নাসা গ্রুপের কর্ণধার নজরুল ইসলাম মজুমদারের বিষয়েও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে সিআইডি। নজরুল ইসলামকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ গ্রেফতারের পর রাজধানীর মিন্টু রোডে ডিবি কার্যালয়ে কয়েক দফা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সিআইডির একটি টিম। তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, নজরুল ইসলামের দেওয়া তথ্যে সৌদি আরবে খেজুরবাগান করার নামে অর্থ পাচারের ঘটনায় ফেঁসে যাচ্ছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এক গভর্নর। ওই গভর্নরের অনুমতি নিয়েই দেশের বাইরে টাকা পাঠিয়েছে বলে সিআইডির জিজ্ঞাসাবাদে দাবি করেছেন নজরুল ইসলাম। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি)-এর সভাপতি থাকাকালে রানা প্লাজা ধসের পর ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ত্রাণভান্ডারে বিএবির পক্ষ থেকে ৬০০ কোটি টাকা দেন। সেই টাকা হতাহতদের পরিবারকে না দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের লোকেরা লুটপাট করেছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন তিনি। এদিকে ট্রেড বেইজড মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৩ মিলিয়ন ডলার পাচারের তথ্যপ্রমাণ সিআইডির প্রাথমিক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
সূত্র বলছে, স্বর্ণ ও হীরা চোরাচালানের অভিযোগে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড এবং এর স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অনুসন্ধান শুরু করেছে সিআইডি। ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দীলিপ কুমার আগরওয়ালার বিরুদ্ধে চোরাচালানের মাধ্যমে বিদেশ থেকে সোনা ও হীরা আমদানির নামে অর্থ পাচারের অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে। প্রতারণা ও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে বিভিন্ন জেলায় নামমাত্র শোরুমের মাধ্যমে প্রকৃত ডায়মন্ডের বদলে উন্নতমানের কাচের টুকরোকে প্রকৃত ডায়মন্ড হিসাবে বিক্রি এবং দুবাই-সিঙ্গাপুরে স্বর্ণ চোরাচালান সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি-এমন অভিযোগেরও অনুসন্ধান চলছে।
এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আলোচিত এস আলম গ্রুপের মালিক মো. সাইফুল আলমসহ তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে ‘প্রতারণা, জালিয়াতি, ওভার ইনভয়েস, আন্ডার ইনভয়েস ও সংঘবদ্ধ অপরাধের মাধ্যমে হুন্ডি কার্যক্রম পরিচালনা’ করে প্রায় ১ লাখ ১৩ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করেছে সিআইডি।
অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি অর্থ পাচার ঠেকাতে কার্যকর কোনো উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিদেশে বিপুল অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িতদের বিষয়ে নানামুখী অনুসন্ধান শুরু হয়।
সিআইডি প্রধান অ্যাডিশনাল আইজিপি মো. মতিউর রহমান শেখ যুগান্তরকে বলেন, ‘অনুসন্ধান কার্যক্রমগুলো মূল্যায়ন করা হচ্ছে। যেসব কর্মকর্তা দায়িত্বশীল আছেন, তাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অনুসন্ধানের ওপর ভিত্তি করে দ্রুত সময়ের মধ্যে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এর মধ্যে একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ অপরাধচক্রের মাধ্যমে প্রতারণা, জালিয়াতি করে অর্থ উপার্জন এবং বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে। অনুসন্ধানের অংশ হিসাবে অভিযুক্তদের ব্যাংক হিসাবের লেনদেনসহ বিভিন্ন তথ্য চেয়ে অর্থ পাচার প্রতিরোধে সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা বিএফআইইউ (বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট)-এর কাছে চিঠি দেন সিআইডির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। সিআইডি অনুসন্ধানের বিষয়টি পুলিশ সদর দপ্তরকেও অবগত করেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কয়েক বছর ধরেই ডলার সংকট, ভঙ্গুর অর্থনীতি, মূল্যস্ফীতিসহ নানা ধরনের টানাপোড়েনে দেশের অর্থনীতি-যার অন্যতম কারণ অর্থ পাচার। বৈশ্বিক বাণিজ্যভিত্তিক কারসাজি, হুন্ডি, চোরাচালানসহ নানা পন্থায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার করা হয়েছে অর্থ। ওয়াশিংটনভিত্তিক অর্থিক খাতের গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) গবেষণায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশে শুধু ব্যক্তিপর্যায়েই নয়, অর্থ পাচার প্রক্রিয়ায় পরোক্ষভাবে যুক্ত হয়েছে দেশের একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকও। সিপিডি বলছে, গত দেড় যুগে দেশের ১৯টি ব্যাংক থেকে আত্মসাৎ করা মাত্র ২৪টি ঋণ কেলেঙ্কারির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে একশ হাজার কোটিরও বেশি টাকা পাচার হয়েছে।